din9808
৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, ৪:৩৩ অপরাহ্ন
অনলাইন সংস্করণ

রাহাত খান: বটবৃক্ষের ছায়া আমার

রাহাত খান। ফাইল ছবি

সাংবাদিক রাহাত খান। স্বনামে পরিচিত দেশের প্রগতিশীল ধারার অন্যতম ব্যক্তিত্ব তিনি। এই মৃদুভাষী, নিরহঙ্কার ও নিভৃতচারী ব্যক্তিত্বের লেখনী শুধু সাংবাদিকতা ক্ষেত্রকেই আলোকিত করেনি। নিপুণ কথাশিল্পী- কথাকার রাহাত খানের লেখনি জীবন ও সাহিত্যের প্রতিটি ধারাকেই স্পর্শ করেছে। সমৃদ্ধ করেছে।https://21c8cc4ca88d0bd7b6d1413c6a25c758.safeframe.googlesyndication.com/safeframe/1-0-37/html/container.html

দীর্ঘদিন এই মহান ব্যক্তিটির ঘনিষ্ঠ সাহচার্য লাভের সুযোগ হয়েছিল আমার। রাজধানী শহরে তিনিই ছিলেন আমার বটবৃক্ষের ছায়া। শুক্রবার রাতে রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেনের বাসায় অসাধারণ আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন প্রিয় ব্যক্তিটি অনন্ত পথের যাত্রী হয়েছেন। মাথার উপর থেকে সেই বট বৃক্ষের ছায়া সরে গিয়ে রাজধানীতে এখন ঝলসানো প্রখর রোদের দাপট। কোথাও কী আর এমন কোনো বটবৃক্ষের শীতল ছায়ার পরশ পাবো?

এই তো সেদিন শুনেছিলাম দেশ বরেণ্য প্রখ্যাত সাংবাদিক, কথাশিল্পী ও ঔপন্যাসিক রাহাত খান গুরুতর অসুস্থ হয়ে সংকটাপন্ন অবস্থায় রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেনের বাসায় শয্যাশায়ী আছেন।

এমন খবর জেনে ২০ জুলাই সোমবার রাত ১০টা ৫৯ মিনিটে রাহাত ভাইয়ের ব্যক্তিগত সেলফোন নাম্বারে আমি রিং দেই।

সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ফোন রিসিভ করে বলতে শুরু করলেন, নিজামও কী আমার ইন্টারভিউ নিতে চাচ্ছ না-কি? আমার শরীরটা খুবই খারাপ। আগামী সপ্তাহে সময় করে রিং দিও।

উত্তরে আমি বললাম, অবশ্যই রাহাত ভাই আগামী সপ্তাহে আমি রিং দিবো। কিন্তু আজ আপনার শরীরের অবস্থা জানতেই এতো রাত বিবেচনা না করেও আপনাকে রিং দিলাম।

তাৎক্ষণিক আবার তিনি বলে উঠলেন, না না নিজাম। আমার অনেক কথা আছে, সেসব তোমাকে বলবো বলে। কতোদিন কথা হয়নি তোমার সঙ্গে। এমনিতেও তো অনেক কথা জমে আছে তাই নয় কি?https://21c8cc4ca88d0bd7b6d1413c6a25c758.safeframe.googlesyndication.com/safeframe/1-0-37/html/container.html

আমি আবার বললাম ঠিক আছে রাহাত ভাই, তাই হবে। কিন্তু; ওই রাতে আমার সঙ্গে কথা বলার পরের দিন ২১ জুলাই তিনি আরও গুরুতর অসুস্থ হয়ে পরলে স্ত্রী অপর্ণা খান তাকে নিয়ে রাজধানীর বারডেম হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করেন।

সে সময় আমি এ বিষয় নিয়ে সাংবাদিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউট (পিআইবির)-এর মহাপরিচালক জাফর ওয়াজেদ ভাই এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদের সঙ্গে কথা বলি।

তারা তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে রাহাত খানের খোঁজখবর ও দেখভালের ব্যবস্থা করেন।

বারডেমে বেশ কিছুদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠলে তিনি ছাড়পত্র নিয়ে আবার বাসায় ফিরে যান। আর সেখানেই শুক্রবার রাতে অনন্ত পথের যাত্রী হলেন তিনি।

দুর্ভাগ্য আমার আমাকে বটবৃক্ষের মতো ছায়া দেয়া দেশ বরেণ্য ব্যক্তিত্ব রাহাত খানের সঙ্গে ফোনে শেষ কথাটি শোনার সুযোগ হল না।

এ দুঃখ ও বেদনার ভার আমাকে সারাজীবন খুঁড়ে খুঁড়ে খাবে। আজ তার অনন্ত যাত্রার পর বারবার মনে হচ্ছে, মনে প্রশ্নের বুদ্বুদ সৃষ্টি হচ্ছে, কী কথা ছিল আমার সঙ্গে। তিনি আমাকে কী বলতে চেয়েছিলেন অথবা জানাতে চেয়েছিলেন?

রাহাত খান এবং আমার বয়সের ব্যবধান বিস্তর। কিন্তু তিনি নিজেই সে ব্যবধান চুকিয়ে দিয়ে এক সময় আমাকে তার ঘনিষ্ঠ করে, আপন করে নিয়েছিলেন।

আর সে সম্পর্ক ১৯৮৯ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত নবায়নের প্রয়োজন পড়েনি। আমি ১৯৮৯ সালে বাংলার বাণী ছেড়ে চতুর্থ ওয়েজবোর্ড নিয়ে অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলায় রিপোর্টার হিসেবে যোগদান করি।

ওই টরেটক্কা ও টেলিপ্রিন্টার্সের যুগে মাসে দু’চার দিন পেশাগত কাজেই ঢাকায় দৈনিক বাংলা অফিসে যেতে হতো। আর অবসর সময় কাটতো রামকৃষ্ণ মিশন রোডে অবস্থিত দৈনিক ইত্তেফাক অফিসে প্রখ্যাত সাংবাদিক রাহাত খানের চেম্বারই ছিল একমাত্র ভরসা।

কেন জানি তিনি আমাকে কাছে পেলে সহজে ছাড়তে চাইতেন না। অবশ্য, আমিও এমন বটবৃক্ষের ছায়া লুফে নিতাম। মাঝেমধ্যে এ নিয়ে রঙ্গ-রসও কম হতো না।

আমি এক বিকালের প্রাণ খোলা আড্ডায় রাহাত খানকে বলে বসলাম যে, পীর মতিউর রহমান ওরফে ক্যাপ্টেন হামিদের মুসলিম মিল্লাত পার্টি নিয়ে একটি বিশেষ ফলোআপ রিপোর্ট আছে। এ নিয়ে সম্পাদক মহোদয়ের সঙ্গেও হয়তো কথা বলতে হবে।

এ কথা বলা শেষ করতে না করতেই তিনি রিং করে টেলিফোনের রিসিভার উঠিয়ে দৈনিক বাংলা সম্পাদক প্রখ্যাত সাংবাদিক আহমেদ হুমায়ুনকে বলতে শুরু করলেন, হুমায়ুন তোমার কিশোরগঞ্জের চারণ সাংবাদিক এ টি এম নিজাম দেখছি আজকাল সৌজন্যতাবোধটুকুও ভুলে গেছে।

তার নাকি রাহাত খানের সঙ্গেও কথা বলার সুযোগ নেই। তোমার সঙ্গে নাকি ওর বিশেষ কী কাজ আছে?

এসব শুনে আমি হাসতে হাসতে কুটি কুটি অবস্থা। কিন্তু রাহাত ভাই হঠাৎ রিসিভার ধরিয়ে দিলেন আমার হাতে। আমি হুমায়ূন ভাইকে সালাম জানাতে জানাতেই তিনি বললেন, আগে রাহাতের কাজ সারো। আমি পত্রিকা লে-আউট পর্যন্ত দৈনিক বাংলা অফিসে আছি।

তারপর ঘড়ি বন্ধ করে আড্ডা। সে আড্ডা জুড়ে ছিল তাঁর দূরন্ত শৈশব-কৈশোর আর যৌবনের দুঃখ-বেদনা আর হাসি কান্নার কথা।

ছিল কিশোরগঞ্জের তাড়াইলের জাওয়ার এবং ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজের শিক্ষকতার কথা। এমনকি ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে রংপুরের কারমাইকেল কলেজে বদলি এবং শেষ পর্যন্ত ইত্তেফাকে স্থায়ীভাবে আসন পাতার কথাও।

তবে ১৯৯৬ সালে দৈনিক বাংলা বন্ধ হয়ে গেলে তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ কমে যায়। কারণ তখন থেকে ফ্যাক্সসহ তথ্য আদানপ্রদানের নানা সুযোগ সামনে আসায় ঢাকায় কম যাওয়া হতো। কিন্তু রাহাত ভাই নাছোড়বান্দা। সম্ভবত ২০১২ সালের একদিন একটা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের কার্ড পাঠালেন আমাকে। আর সেই কার্ড দেখে আমার চোখ চরকগাছ।

কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলা সদরে তার সম্মানে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। এ অনুষ্ঠানে রাহাত খান প্রধান অতিথি আর আমি প্রধান বক্তা।

আমি সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোন করি রাহাত ভাইকে। বলি, আপনার অনুষ্ঠানে আমি যাব না। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, কেন নিজাম কী হয়েছে? আমি উত্তরে বললাম, কী হয়েছে মানে, আপনি প্রধান অতিথি আর আমি প্রধান বক্তা, এ কী করে হয়?

এবার তিনি বুঝতে পেরে কৌশলের আশ্রয় নিয়ে সবিনয়ে বললেন, আচ্ছা, তুমি বল তো নিজাম কিশোরগঞ্জের সাংবাদিকদের মধ্যে আমি আর কাকে প্রধান বক্তা বানাবো। এবার আমি চুপসে গিয়ে বললাম, আমি এক শর্তে অনুষ্ঠানে যাব।

আর সে শর্ত হ’ল ঢাকায় ফিরার দিন যুগান্তরের কিশোরগঞ্জ অফিসে দুপুরের খাবার খেতে হবে।

তিনি তাই করলেন ওই অনুষ্ঠান শেষে পরের দিন ঢাকায় ফেরার পথে সকাল সকাল যুগান্তর অফিসে এসে পৌঁছে যান। সেখানে স্থানীয় ইত্তেফাক সংবাদদাতা সুবীর বসাকের সঙ্গে আরও অনেকে অংশ নেন। শুরু হয় দীর্ঘ সময় ঘড়ি বন্ধ করে আড্ডা।

দুপুরের খাবার সারার পরও সে আড্ডা শেষ হয়নি। শেষ বিকালে তাকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ফিরে যেতে হয়। ঢাকার ফেরার পথে আমার কথা নিয়েছিলেন, যে আমি কয়েকদিনের মধ্যে ঢাকায় তার অফিসে যাব। কিন্তু আর যাওয়া হয়নি।

আরও কিছুদিন পরের কথা। একদিন কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজের স্বত্বাধিকারী সিআইপি মূসা মিয়ার নিমন্ত্রণ।

ওখানে রাহাত ভাই সস্ত্রীক বেড়াতে আসছেন। আমি রাহাত ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ থাকার সুবাদে তার পরিবারের সকল সদস্য আমার চেনা। কিন্তু অল্প বয়সী অপর্ণা খানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার খবরটি কেন জানি তিনি গোপন করেছিলেন আমার কাছে। পরের দিন কিশোরগঞ্জ প্রেসক্লাব নেতৃবৃন্দসহ সিনিয়র অনেক সাংবাদিকরা সেখানে উপস্থিত হলাম।

কোল্ড স্টোরেজের ওই বিশেষ গেস্ট হাউস এর দরোজা বরাবর যেতেই সবার মাঝখান থেকে আমায় ধরে টেনে নিয়ে অপর্ণা খানকে দেখিয়ে বললেন, নিজাম তোমার ভাবী।

আমি ইতস্ততবোধ করার আগেই ডাক পড়ে খাবার টেবিলে বসার।

আর সেদিন থেকে অপর্ণা খানকেও চেনা হ’ল। মাঝেমধ্যে নতুন দাম্পত্য জীবনের খোঁজ নিয়ে যতটুকু জেনেছি, শেষ জীবন রাহাত ভাই তার নিজের মতো করে ভালোই চালিয়ে গেছেন।

রাহাত খানকে নিয়ে এমন অনেক মিষ্টি মধুর স্মৃতি আছে আমার। এসব স্মৃতিই তাকে আজীবন মনে রাখার প্রেরণা হিসাবে কাজ করবে। মনে থাকবে, তার বাসায় এলসেশিয়ান কুকুরের পাল্লায় পড়ে ভয় পাওয়ার স্মৃতিও। বর্তমানে তাঁর আমেরিকার ক্যালিফোনিয়া প্রবাসী মেয়ে সাবরিনা খানম সেদিন কুকুরের ভয় ভাঙিয়ে আমাকে বলেছিলেন, আব্বু ( রাহাত খান) অফিসে।

সাংবাদিকতায় অসামান্য অবদান আর বিপুল সাহিত্য সম্ভার রেখে আজ সেই রাহাত খান অনন্ত পথের যাত্রী। ঠাঁই হচ্ছে বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে।

ওপারে ভাল থাকবেন রাহাত ভাই, ভাল থাকবেন।

লেখক: এ টি এম নিজাম

ব্যুরো চিফ, যুগান্তর কিশোরগঞ্জ ব্যুরো

Facebook Comments Box

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিএনপি পদ থেকে বহিষ্কার করার প্রতিবাদে মানববন্ধন।

শ্রীনগরে বিএনপির মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত

শ্রীনগরের জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে চারজনকে কুপিয়ে আহত

শ্রীনগরে ভুয়া এডিশনাল ডিআইজি আটক

শ্রীনগরে নববধূ রহস্যজনক মৃত্যু

শ্রীনগরে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে নারী নিহত ও একই পরিবারের তিনজন গুরুতর আহত

ঢাকা মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৫

শ্রীনগরে এক্সপ্রেসওয়েতে অস্ত্র হাতে ভাইরাল ভিডিওর ৫ ডাকাত গ্রেপ্তার

শ্রীনগরে আন্তঃজেলা ডাকাত দলের ৪ সদস্য গ্রেফতার,লুট হওয়া মালামাল ও সরঞ্জাম উদ্ধার

শ্রীনগরের যাত্রীবাহী বাসের চাপায় অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি নিহত

১০

ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে বাসচাপায় অজ্ঞাত বৃদ্ধ নিহত, ঘাতক বাস আটক

১১

শ্রীনগরে বিদেশী পিস্তল ও ম্যাগাজিন উদ্ধার

১২

শ্রীনগরে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাসী হামলায় আহত ১০, বাড়িঘর ভাঙচুর

১৩

ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে পৃথক মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ৩

১৪

শ্রীনগরে ইউপি চেয়ারম্যান গ্রেফতার

১৫

শ্রীনগর পদ্মা নদীতে গোসল করতে গিয়ে যুবকের মৃত্যু

১৬

শ্রীনগরে বস্ত্র ব্যবসায়ীর বাড়িতে সন্ত্রাসী হামলা, ইউপি সদস্যসহ গ্রেপ্তার ১০

১৭

বৈশাখের প্রথম প্রহরে শ্রীনগরে বর্ষবরণ ও আনন্দ শোভাযাত্রা

১৮

শ্রীনগরে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে অটোচালক আহত

১৯

শ্রীনগরে অটোরিকশা ছিনতাইকালে গণপিটুনিতে এক ছিনতাইকারী নিহত, আহত দুই

২০